ইমাম বুখারী নিশাপুরে ঠাঁই পেলেন না। তাঁর আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা দেখে চারদিকে কিছু হিংসুক তৈরি হল। হিংসুকের হিংসা এবং ভ্রষ্ট শাসকের জুলুমি সিদ্ধান্ত তাঁকে আর থাকতেই দিল না নিশাপুরে। রাষ্ট্রীয় ফরমান জারি হল, "ঠিক এখনই নিশাপুর ত্যাগ করুন।"
শাসকের ক্ষোভের পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ ছিল, রাজদরবারে গিয়ে তার ছেলেকে পড়ানোর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দেওয়া। রাষ্ট্রীয় এই প্রস্তাবের জবাবে তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন, "জ্ঞান মজলিসে বসেই নিত হয়, ঘরের দরজায় গিয়ে বিলি করা হয় না।"
আপনার প্রয়োজনীয় কোর্সটি ফ্রি ডাউনলোড করে নিন।
এদিকে নিশাপুরের গভর্নর আরো বেসামাল। তার ক্ষোভ যেন কিছুতেই কমছে না। বুখারাতে ইমাম আশ্রয় নিয়েছেন—এই সংবাদ পেয়ে বুখারার গভর্নরের কাছে পত্র লিখল। পত্রের সারমর্ম ছিল এমন, "লোকটাকে নিশাপুর থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আপনার রাজ্যের কল্যাণের জন্য ওকে বুখারা থেকেও বহিষ্কার করুন।"
শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা তারিখ নিয়ে দুই চিন্তা
বুখারার গভর্নরের রাগে যেন ঘি পড়ল। জ্বলে উঠল ছ্যাঁৎ করে। সঙ্গেসঙ্গে রাজকীয় পিয়নের মাধ্যমে বহিষ্কারাদেশ পাঠানো হল। সেখানে লেখা ছিল, "ঠিক এই মুহূর্তে বুখারা ছাড়ুন।"বাধ্য হয়ে ইমাম বুখারী রাহি. বুখারা ত্যাগ করলেন। কোথায় যাবেন তখন, তাঁর জানা ছিল না। যেখানেই যাচ্ছিলেন সেখান থেকেই বের করে দেওয়া হচ্ছিল। তিনি বুখারা থেকে বের হয়ে নির্জন প্রান্তরে তাঁবু টানিয়ে তিনদিন অবস্থান করেছিলেন, যাতে সব কিতাবাদি সংগ্রহ করে সাথে করে নেওয়া যায়। কারণ, এই জন্মস্থানে তো আর আসা হবে না। তাঁর একান্ত সঙ্গী হিসেবে ছিলেন ইবরাহীম বিন মাকীল।
হঠাৎ ইমামের মনে হল, সমরকন্দের খারাতনাক গ্রামে তাঁর এক আত্মীয়ের বসবাস। সেখানে চলে গেলে মন্দ হবে না। জীবনের বাকিটা সময় অপরিচিত সেই গ্রামের নির্জনতায় কাটিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কিইবা করার আছে!
চললেন আত্মীয়ের বাসার দিকে। চলতে চলতে পৌঁছে গেলেন সমরকন্দের অন্তর্ভুক্ত খারাতনাক গ্রামে অবস্থিত আত্মীয়ের বাসায়। তাঁরা ইমামকে খুশিতে বুকে টেনে নিলেন। গ্রামের মানুষ বেজায় খুশি।
এদিকে হিংসুকদের দৃষ্টিও ইমামের পিছনে পিছনে চলতে লাগল। সংঘবদ্ধ চক্র খবর রাখছিল, ইমাম বুখারী কোথায় গিয়ে আশ্রয় নেয়৷ যেখানেই আশ্রয় নেবে সেখান থেকেই তাড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
তারা তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সমরকন্দের শাসকের কাছে রাষ্ট্রীয় চিঠি চালাচালি করে ইমামের অবস্থান শনাক্ত করে সেখান থেকে বহিষ্কার করার অনুরোধ জানাল। সমরকন্দের শাসক চিঠির হুকুম তামিল করল। রাষ্ট্রীয় বার্তাবাহক বহিষ্কারাদেশ ফরমান নিয়ে হাজির হল অজপাড়া সেই গ্রামে।
তখন ঈদের রাত। রাত পোহালেই ঈদুল ফিতর। চিঠিটাও লিখছিল সেভাবেই। "এখনই বের হোন, ঈদের পরে নয়।" এটা পড়ে ইমাম একমুহূর্ত অবস্থান করার চিন্তা করলেন না। তিনি নিজের জীবনের চেয়ে আশ্রয়দাতা আত্মীয়ের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন বেশি। ভাবলেন, যদি এখনই অর্থাৎ ঈদের রাতেই ত্যাগ না করি তাহলে বাড়ির কর্তাদের ওপর জুলুম করা হতে পারে।
আবার চললেন ইমাম বুখারী। বের হয়ে বিশ কদম এগুতে পারলেন না। ক্লান্ত হয়ে গেলেন খুব। এতটাই ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিলেন যে, তাঁর স্বাভাবিক নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল। ইবরাহীম বিন মাকীলকে বললেন, যাতে সে তাঁকে একটু বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ দেয়। ইবরাহীম বিন মাকীল তড়িঘড়ি করে তাঁর শায়খকে রাস্তার পাশেই বসিয়ে দিলেন। ইমাম বুখারী বসা থেকে শুইয়ে চোখদুটো বন্ধ করে দিলেন। বিন মাকীল মনে করলেন শায়খ আমার ঘুমুচ্ছেন। তিনি যাত্রা শুরু করার জন্য কিছুক্ষণ পর ইমামের মাথায় আলতো করে হাত রেখে ডাকতে থাকলেন। না, কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। এবার আরেকটু নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখলেন, ইমাম আর এই দুনিয়াতে নেই। তিনি তাঁর রবের সাক্ষাতে বের হয়ে গেছেন।
ইমাম বুখারী রাস্তার পাশে মারা গিয়েছিলেন।
ঈদের রাতে ঘর থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন।
২৫৬ হিজরীর পহেলা শাওয়ালে মারা গিয়েছিলেন।
তিনি যেসময় ছন্নছাড়া হয়ে এই শহর থেকে ওই শহরে ঘুরছিলেন তখন তাঁর বয়স ছিল ৬২ বছর।
১২০০ বছর পর আজ ইমাম বুখারীর নাম সবার মুখেমুখে। কিন্তু যেই শাসক এবং হিংসুকরা তাঁর পিছনে লেগেছিল তাদের নাম পর্যন্ত আজ অবশিষ্ট নেই। ইমাম বুখারীকে পড়বে, জানবে এবং রিসার্চ করবে কিয়ামত পর্যন্ত। বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষ ইমামের জ্ঞান থেকে ইস্তেফাদা নেবেন। তিনি উলুমুল হাদীসের রাজ্যে রাজাই থাকবেন। আর যারা তাঁর পিছনে লেগে তাঁকে চরম কষ্ট দিয়েছিল তারা কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে সেই কবে!
হযরত ইমাম বুখারী (রহঃ) পরিচয়
হযরত ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর আসল নাম মুহাম্মদ, পিতার নাম ইসমাঈল। ডাকনাম আবূ আবদুল্লাহ। পূর্বপুরুষ ইরানের অধিবাসী। তাঁর প্রপিতা মুগীরা বিন বারদেজবেহ হযরত ইসমাঈল জু’ফীর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত ইমাম বোখারী ১৮৪ হিজরী সালের ১৩ই শাওয়াল জুমআর দিন বাদ জুমআ বোখারায় জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবেই তাঁর পিতৃবিয়োগ ঘটে। মাতৃস্নেহে তিনি লালিত পালিত হতে থাকেন। শৈশবেই তাঁর তীক্ষ্ণ মেধা ও স্মৃতিশক্তি সবাইকে চমৎকৃত করে। মাত্র দশ বৎসর বয়সেই তিনি সনদসহ কয়েক হাজার হাদীস মুখস্থ করে ফেলেন।
অথচ হাদীস মুখস্থ করা পবিত্র কোরআন মুখস্থ করার মত নয়। কারণ, হাদীসের মধ্যে শুধু মতন বা বিষয়বস্তুই নয়, বরং সনদ বা বর্ণনা সূত্রেরও বিরাট ধারাক্রম রয়েছে। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ নাম। এগুলো যথাযথ মুখস্থ করে ধরে রাখা সহজ কথা নয়, কিন্তু হযরত ইমাম বুখারী (রহঃ) পক্ষে এও একেবারে সহজসাধ্য ছিল। তাঁর বাল্যকালের একটি ঘটনা অত্যন্ত চমকপ্রদ। তিনি যখন দশ বছরের কিশোর। তখন তৎকালীন শ্রেষ্ঠ হাদীস বিশারদ হযরত ইমাম দাখেলী (রঃ)-এর শিক্ষাঙ্গনে হাদীসের পাঠ গ্রহণ করছিলেন। একদিন ইমাম দাখেলী একখানা হাদীস সনদ সহকারে পাঠ করলেন।
(সুফিয়ান আবু যোবায়র থেকে তিনি ইবরাহীম থেকে বর্ণনা করেছেন)। তখন ইমাম বোখারী (রাঃ) প্রতিবাদ করে বললেন, ওস্তাদজী! আবূ যোবায়র তো ইবরাহীম থেকে বর্ণনা করেননি। ইমাম দাখেলী তাঁকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন। কিন্তু তিনি না থেমে ওস্তাদকে বললেন, “হযরত! মেহেরবানী করে একবার আপনার বক্তব্য মূল পাণ্ডুলিপির সাথে মিলিয়ে দেখুন। তিনি অতিরিক্ত জোর দেয়ায় ওস্তাদের মনে সংশয় দেখা দেয়, তিনি পাণ্ডুলিপির সাথে মিলাতে গিয়ে দেখলেন, তাঁর ভুল হয়েছে।”
তাই ফিরে এসে ইমাম বোখারীকে বললেন, “তা হলে তুমি-ই বল সনদটি কী হবে”? উত্তরে ইমাম বোখারী বললেন-(সুফিয়ান যোবায়র ইবনে আদী থেকে, তিনি ইবরাহীম থেকে বর্ণনা করেছেন)। তখন ওস্তাদ দাখেলী সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মূল কপি সংশোধন করে নিয়ে বললেন, “তোমার কথাই ঠিক”। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক এবং ইমাম ওকী (রঃ) -এর সংগৃহীত সমুদয় হাদীস কণ্ঠস্থ করে ফেলেন। হাদীস সংগ্রহের জন্য তিনি সিরিয়া, মিসর, বসরা, কুফা, ইরাক ও হেজায (মক্কা মদীনা) সফর করেন।
এ সময় তিনি লক্ষ লক্ষ হাদীসের হাফেজ হন। আঠার বছর বয়সেই তিনি গ্রন্থ রচনায় হাত দেন। এ সময় সাহাবী ও তাবেঈদের বাণী সম্বলিত একটি গ্রন্থ এবং। একটি ইতিহাস গ্রন্থও এ সময় তিনি রচনা করেন।হযরত ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর শারীরিক গঠন ছিল হালকা পাতলা ধরনের।
তিনি খুব লম্বা বা বেঁটে ছিলেন না, বরং মধ্যবর্তী গঠনের ছিলেন। তিনি ছিলেন দরবেশ প্রকৃতির লোক আবেদ জাহেদ। পৈতৃক সূত্রে অনেক সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। তা সবই আল্লাহর রাস্তায় সদকা করে দেন তিনি খুব কম খেতেন। শাগরেদদের প্রতি ছিলেন খুবই মহানুভব, দয়ালু এবং সাধারণ লোকদের প্রতি ছিলেন দানশীল।
হযরত ইমাম বুখারী (রহঃ) ২৫৬ হিজরী সনে ঈদুল ফেতরের (শনিবার দিবাগত) রাতে এশার নামাযের পর ইন্তেকাল করেন। এ সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ১৩ দিন কম ৬২ বছর। সমরকন্দ থেকে দু’ফার্লং দূরবর্তী 'খরতঙ্গ' নামক এক পল্লী গ্রামে তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর কোন পুত্র সন্তান ছিলেন না। বর্ণিত আছে, জানাযার নামায আদায় করার পর যখন তাঁকে তাঁর কবরে রাখা হয়, তখন তাঁর কবর শরীফের মাটি হতে মেশক আম্বরের সুগন্ধ বাতাসে প্রবাহিত হয়ে চতুর্দিক মোহিত করে ফেলে। বিশেষ এক সময় পর্যন্ত লোকেরা কবরের মাটি নিয়ে তা থেকে মেশক আম্বরের সুগন্ধ গ্রহণ করতেন এবং আশ্চর্য বোধ করতেন।
এক আল্লাহর ওলী বর্ণনা করেন, আমি একদা স্বপ্নযোগে দেখতে পেলাম, কতিপয় সাহাবী রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে এক জায়গায় অপেক্ষা করছেন। আমি রাসূল (সঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা এখানে কেন অপেক্ষা করছেন? উত্তরে তিনি বললেন, “আমরা মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল বোখারীর জন্য অপেক্ষা করছি। কয়েকদিন পর যখন আমি তাঁর মৃত্যু সংবাদ শুনতে পাই, তখন স্বপ্নের দিকে লক্ষ্য করে দেখলাম, আমি যে সময় এ স্বপ্ন দেখেছি, ঐ রাতেই হযরতহযরত ইমাম বুখারী (রহঃ) ইন্তেকাল করেন।”
হযরত হযরত ইমাম বুখারী (রহঃ)বিশিষ্ট শাগরেদ ইমাম ফারাবী (রঃ) বলেন, “আমি একদা স্বপ্নযোগেহযরত ইমাম বুখারী (রহঃ)-কে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পেছনে পেছনে যেতে দেখলাম। আমি দেখলাম, রাসূল (সঃ) যখনই তাঁর কদম মোবারক উঠাচ্ছেন, ইমাম বোখারী সে স্থানেই পা মোবারক রেখে হাঁটছেন।”
মুহাম্মদ ইবনে হামদুওয়ায়হ (রঃ) বলেন, “আমিহযরত ইমাম বুখারী (রহঃ)-কে বলতে শুনেছি; তিনি বলেছেন, আমি এক লক্ষ সহীহ হাদীস এবং দু'লক্ষ গায়রে সহীহ হাদীস মুখস্থ করেছি। অপর বর্ণনা মতে, তিনি ছয় লক্ষ হাদীসের হাফেজ ছিলেন।”
হযরত ইমাম বুখারী (রহঃ)ওস্তাদ মুহাম্মদ ইবনে বাশার (রঃ) বলেন, “দুনিয়াতে উল্লেখযোগ্য চার জন হাফেজে হাদীস আগমন করেছেন। তাঁরা হলেন-(১) ‘রায়’তে আবু যোরআ (রঃ), (২) নিশাপুরে মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ, (৩) সমরকন্দে ইমাম দারেমী এবং (৪) বোখারায় মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল বোখারী (রঃ)। তবে তাঁদের মধ্যে ইমাম বোখারী সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য।” ইমাম মুসলিম (রঃ) তাঁর সম্পর্কে বলেন, “হে ইমাম! হিংসুক ছাড়া অন্য কেউ আপনার সাথে দুশমনী করতে পারে না। আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, দুনিয়াতে হাদীস শাস্ত্রে আপনার অনুরূপ আর কেউ নেই।”
হাকেম আবূ আবদুল্লাহ (রঃ) আহমদ ইবনে হামদুন হতে বর্ণনা করেন, একদা মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ (রঃ) হযরত হযরত ইমাম বুখারী (রহঃ)দরবারে উপস্থিত হয়ে তাঁর ললাটে চুম্বন দিয়ে বললেন, হে ওস্তাদগণের ওস্তাদ! হে মোহাদ্দেসগণের সর্দার! আপনি আমাকে ছেড়ে দিন, আমি আপনার কদম মোবারক চুম্বন করি। ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক ইবনে কুজাইমা (রঃ) বলেন, আসমানের নীচে আমি মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল বোখারী হতে রাসুল (সঃ)-এর হাদীস সম্পর্কে অধিক জ্ঞানী ব্যক্তি আর কাউকে দেখতে পাইনি।
হাকেম আবূ আবদুল্লাহ নিশাপুরের ইতিহাসে বর্ণনা করেন, হযরত ইমাম বোখারী হাদীস সংগ্রহের জন্য এত অধিক পরিশ্রম করেছেন যে, এ উদ্দেশে তিনি মক্কা, মদীনা, সিরিয়া, বোখারা, মার্ড, বলখ, হেরাত, নিশাপুর, রায়, বাগদাদ, ওয়াসেত, বসরা, কুফা, মিসর, জাজীরা ইত্যাদি এলাকায় সফর করে তথাকার বিভিন্ন মোহাদ্দেসীনে কেরাম হতে হাদীস শ্রবণ করেছেন।
জা’ফর ইবনে মুহাম্মদ আলকাত্তান (রঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আমিহযরত ইমাম বুখারী (রহঃ)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, আমি এক হাজারেরও বেশি শায়খ (ওস্তাদ) থেকে হাদীস শ্রবণ করেছি এবং আমার কাছে এমন কোন হাদীস নেই যার সনদ উল্লেখ নেই; বরং প্রত্যেক হাদীসেরই সনদ আছে। তিনি আরো বলেন, ইমাম বোখারী থেকে যারা হাদীস শ্রবণ করেছেন তাদের সংখ্যা অগণিত।”
ইমাম ফারাবী (রঃ) বলেন, নব্বই হাজার মোহাদ্দেস হযরতহযরত ইমাম বুখারী (রহঃ) হতে বোখারী শরীফ শ্রবণ করেছেন, কিন্তু তা রেওয়ায়াত করার মত আমি ছাড়া আর কেউ বাকী নেই ।হযরত ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর শাগরেদদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, হযরত ইমাম মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ (রঃ), ইমাম আবূ ঈসা তিরমিযী, ইমাম নাসাঈ (রঃ), আবৃ হাতেম, আবূ যোরআ, আবূ ইসহাক, সালেহ ইবনে মুহাম্মদ, আবূ বকর ইবনে খোযায়মা, ইয়াহইয়া বিন মুহাম্মদ, মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ (রঃ)- এঁরা সবাই হাফেজে হাদীস ছিলেন।
‘তাইসীর’ নামক কিতাবে উল্লেখ রয়েছে,হযরত ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেছেন, আমি ছয় লক্ষ হাদীস থেকে বোখারী শরীফ প্রণয়ন করেছি এবং প্রত্যেকটি হাদীস লেখার পূর্বে গোসল করে দু'রাকআত নফল নামায আদায় করে তার পর তা কিতাবে লেখেছি। বোখারী শরীফ ছাড়াওহযরত ইমাম বুখারী (রহঃ) আরো অনেক কিতাব রচনা করেছেন। যেমন, আদাবুল মুফরাদ, রফউল ইয়াদাইন, কেরাআত খালফাল ইমাম, বিররুল ওয়ালিদাইন, তারীখে কবীর, তারীখে সগীর, তারীখে আওসাত, খালকে আফআলুল ইবাদ, কিতাবু দদোআ', জামেউল কবীর, মুসনাদুল কবীর, কিতাবুল আশরেবাহ, কিতাবুল হেবা, আসমাউস সাহাবা, কিতাবুল ইলাল, কিতাবুল বিজদান, কিতাবুল মাবসুত, এছাড়া আরো অনেক কিতাব।
বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন, “আমি এক হাজার আটশ শায়খ থেকে হাদীস রেওয়ায়াত করেছি এবং তাঁর কাছ থেকে অসংখ্য মোহাদ্দেস হাদীস রেওয়ায়াত করেছেন।” মোদ্দাকথা, ইমাম বোখারী এলমে হাদীসের খেদমতেই জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন।
জামে সহীহ বুখারী :
সহীহ বা বিশুদ্ধ হাদীসের কিতাবসমূহের মধ্যে সহীহ বুখারী শরীফ সর্বপ্রথম, যা সব আলেমের মতেই সর্বাপেক্ষা সহীহ বা বিশুদ্ধতম কিতাব। সহীহ বুখারী শরীফ প্রণয়ন প্রসঙ্গেহযরত ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন, “আমি এক সময় “ইসহাক ইবনে রাহওয়ায়হ (রঃ)-এর খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। সে সময় আমার কোন কোন সাথী আমাদেরকে বললেন, যদি তোমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর হাদীসসমূহের মধ্যে সহীহ হাদীসগুলোর উপর সংক্ষিপ্ত একখানা কিতাব রচনা করতে, তবে কতই না উত্তম হত। সেদিন থেকে এ ধরনের একখানা বিশুদ্ধতম কিতাব রচনা করার ইচ্ছা আমার মনে রেখাপাত করে তাই আমি এ কিতাব রচনায় হাত দেই।”
ইমাম বোখারী (রঃ) হতে বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, “আমি এ সহীহ বুখারী শরীফ সুদীর্ঘ ১৬ বছর যাবৎ একটানা পরিশ্রম করে, ছয় লক্ষ হাদীসের মধ্য থেকে মাত্র কয়েক হাজার হাদীসের সমভিব্যহারে সংকলন করেছি, যা আমি আমার ও মহান আল্লাহর মধ্যে দলিল হিসেবে গ্রহণ করেছি।”
হযরতহযরত ইমাম বুখারী (রহঃ) থেকে আরো বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, “এক সময় আমি জনাব রেসালতে মা’আব (সঃ)-কে স্বপ্নযোগে দেখতে পেলাম। আমি তাঁর সম্মুখে দণ্ডায়মান। আমার হাতে একটি পাখা, যা দ্বারা আমি তাঁর (রাসূল (সঃ)-এর উপর) থেকে মশা-মাছি বিতাড়িত করছি।
আমি কোন তা’বীরকারককে এ স্বপ্ন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, এ স্বপ্ন দ্বারা বুঝা যায়, তুমি রাসূল (সঃ) সম্পর্কে বর্ণিত মিথ্যা হাদীসগুলো দূর করে দিবে। সুতরাং এ স্বপ্ন আমাকে সহীহ বুখারী শরীফ প্রণয়নে তৎপর করে তোলে।”
তিনি আরো বলেন, “আমার এ জামে সহীহ বুখারী তে সহীহ হাদীস ছাড়া অন্য কোন প্রকার হাদীস সংকলন করিনি। সুতরাং সহীহ বুখারী শরীফের সকল হাদীসই সহীহ (বিশুদ্ধতম)। তবে কিতাবের পরিধি বড় হয়ে যাবে, এ ভয়ে অনেক অনেক দীর্ঘায়িত সহীহ হাদীসও আমি এতে উল্লেখ করিনি।”
ইমাম ফারাবী (রঃ) হতে আরো বর্ণিত,হযরত ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেছেন, “ সহীহ বুখারী শরীফে আমি যত হাদীস সংকলন করেছি, প্রত্যেক হাদীস সংকলনের পূর্বে নতুনভাবে গোসল করে পাক পবিত্র হয়ে দু'রাকআত নফল নামায আদায় করে তার পর হাদীসখানা লিপিবদ্ধ করেছি।”
আবদুল কুদ্দুস ইবনে হাম্মাম বলেন, “আমি অনেক শায়খের কাছে শুনেছি, তাঁরা বলেছেন,হযরত ইমাম বুখারী (রহঃ) তাঁর কিতাবে যে সকল “অধ্যায়” বর্ণনা করেছেন, তা নবী করীম (সঃ)-এর মাজার শরীফ এবং মিম্বর শরীফের মধ্যখানে বসে রচনা করেছেন। ইমাম বোখারী বলেন, আমি আশা করি, মহান আল্লাহ মুসলিম সমাজকে এ কিতাব দ্বারা বরকত প্রদান করবেন।”
ইমাম নববী তাঁর ‘তাহযীব’ নামক কিতাবে এবং হাফেজ ইবনে হাজার (রঃ) তাঁর রচিত ফাতহুল বারী' কিতাবের ভূমিকায় বর্ণনা করেছেন, বোখারী শরীফে উল্লিখিত হাদীসের সংখ্যা ৭২৭৫ খানা। আর পুনরুক্ত ছাড়া প্রায় চার হাজার মতান্তরে ৭৩৯৭, ৯০৮২ ইত্যাদি। আবুল মো’তামের মোবারক ইবনে আহমদ বলেন, ইমাম বোখারী তাঁর এ কিতাব প্রণয়নের পূর্বে শর্ত করেছিলেন, তিনি তাঁর কিতাবে কেবল ঐ সমুদয় হাদীসই গ্রহণ করবেন, যে সকল হাদীস কেবলমাত্র বিখ্যাত ও সর্বজনবিদিত সাহাবী হতে বিশ্বস্ত রাবীদের মাধ্যমে মোত্তাসেল (সংযুক্ত) সনদে বর্ণিত হয়েছে।
প্রকাশ থাকে যে, সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে কেবলমাত্র ঐ সকল সহীহ হাদীসই গ্রহণ করা হয়েছে যা রাসূলে পাক (সঃ) থেকে কমপক্ষে দু’দু জন উল্লেখযোগ্য সাহাবীর মাধ্যমে দু'দুজন সেকাহ (বিশ্বস্ত) তাবেঈ কর্তৃক বর্ণিত, তার পর তাদের থেকে অনুরূপভাবে বর্ণিত হয়েছে। তাই এ সহীহ কিতাবদ্বয় মুসলিম সমাজে সমধিক গ্রহণযোগ্য ও প্রামাণ্য হিসেবে খ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
মোদ্দাকথা, একই হাদীসে বিভিন্ন বিষয়ের উল্লেখ থাকায় সে হাদীস বিভিন্ন অধ্যায়ে স্থান লাভ করেছে। আবার কোন কোন বড় হাদীস খণ্ডিত আকারেও বিভিন্ন অধ্যায়ে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। আর ইমাম বোখারী একদিকে যেমন হাদীস শাস্ত্রের ইমাম, অপর দিকে তিনি একজন ফকীহ, ইমাম এবং মুজতাহিদও ছিলেন।
তাই হাদীসের অধ্যায়সমূহ প্রণয়নকালে তিনি পবিত্র কোরআনের অনেক আয়াতও দলিল হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তদুপরি রয়েছে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ইত্যাদি। বিগত প্রায় বারশ বছরে বিভিন্ন ভাষায় এ মহাগ্রন্থখান শত শত ব্যাখ্যা গ্রন্থ প্রণীত হয়েছে এবং বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রাসূলের বাণী বিতরণপূর্বক মানব সমাজকে উপকৃত করে আসছে।
শিক্ষা:
চরম ত্যাগ ছাড়া পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অনুসরণীয় অনুকরণীয় আদর্শ হওয়ার তেমন কোনো সুযোগ নেই।
0 Comments