‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মানুষ গড়ার কারিগর এমপিওভুক্ত প্রায় ছয় লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর মন ভালো নেই। বছর ঘুরে যখন শিক্ষকদের কোনো উৎসবের মুখোমুখি হতে হয় তখন কপালে চিন্তার ভাঁজগুলো একটু একটু করে বড় হতে থাকে। কারণ, একটাই, ‘চার আনা’ তথা মূল বেতনের ২৫ শতাংশ উৎসব ভাতা দিয়ে কীভাবে পরিবার-পরিজন নিয়ে উৎসবের বাড়তি খরচের চাপ সামলাবেন। উল্লেখ্য, ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা ২৫ শতাংশ এবং কর্মচারীরা ৫০ শতাংশ উৎসব ভাতা পান। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী অবশ্যই জেনে থাকবেন, একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষক চাকরির শুরুতে সর্বসাকুল্যে মূল বেতনসহ বারো হাজার সাতশত পঞ্চাশ টাকা পেয়ে থাকেন। এই যৎসামান্য বেতনে একজন শিক্ষকের পক্ষে পরিবার নিয়ে কী আদৌ চলা সম্ভব? একজন শিক্ষকের কথা বাদ দিলাম। একজন সাধারণ মানুষের পক্ষেও কী এই টাকায় সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ মিটিয়ে খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকা সম্ভব!

‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে

এদেশে একজন পোশাক শ্রমিকও মাসে ওভারটাইম মিলিয়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষকের চেয়ে বেশি টাকা বেতন পান। জানা মতে এদেশে আর কোনো চাকরিতে মূল বেতনের ২৫ শতাংশ উৎসব ভাতা নেই। এমনকি বিশ্বের আর কোনো দেশে মূল বেতনের এতো কম উৎসব ভাতা আছে বলে শুনিনি। ২৫ শতাংশ ঈদ বোনাস ঘোষণা করার পর ২০ বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেছে। পরিবর্তনের ছোয়া লেগেছে দেশজুড়ে। স্বল্পোন্নত দেশ আজ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। মধ্যম আয়ের স্মার্ট দেশ হওয়ার পথে এগিয়ে চলেছে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা। কিন্তু এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের যে বোনাস ছিলো সেই বোনাস-ই রয়ে গেছে। যে শিক্ষক ২০ বছর আগে তার পরিবারের এক সদস্যদের জন্য ঈদের কেনাকাটায় ৩০০ টাকা বাজেট রাখতেন ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে এসে সেই শিক্ষককে পরিবারের এক সদস্যদের জন্য আনুষঙ্গিক মিলিয়ে ২০০০ টাকা বাজেটেও হিমশিম খেতে হবে। ২০ বছর আগের আর এখনকার একজন শিক্ষকের ঈদ-উৎসব খরচের মধ্যে আকাশপাতাল পার্থক্য। কিন্তু বাড়তি অর্থ শিক্ষক কোথায় পাবেন?

তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ৭০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী ঠিকমতো পড়তে পারে না

২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে যখন শিক্ষকদের জন্য মূল বেতনের ২৫ ভাগ ও কর্মচারীদের জন্য ৫০ ভাগ উৎসব ভাতার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল তখন আশ্বাস দেয়া হয়েছিলো পরবর্তী বছর থেকে এ খাতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ রেখে শতভাগ উৎসব ভাতা দেয়া হবে। অতঃপর শতভাগ উৎসব ভাতা প্রাপ্তির জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তপক্ষ বরাবর কত-শত মানববন্ধন, স্মারকলিপি দেয়া হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই! সব সময় শিক্ষকদের শুধু আশ্বাসেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। এদেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-কারিগরি পর্যায়ে ৯০ ভাগের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেসরকারি। বেসরকারি এমপিওভুক্ত মেধাবী শিক্ষকরা দেশের মানসম্মত শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা কোনো অংশে কম কাজ করেন না।

মাধ্যমিক ও সমমান পর্যায়ে এদেশের ৯০ ভাগের বেশি শিক্ষার্থী এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে। প্রতিটি সরকারি নির্দেশনা ও কর্মকাণ্ড সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো একই সঙ্গে বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হয়। যদিও সম্প্রতি শিক্ষা প্রশাসন কঠোর হচ্ছেন, রাজনীতি ও মফস্বলে সংবাদাতাসহ বিভিন্ন কাজে যুক্ত হওয়া নিয়ে। 

বোনাস পাওয়ার ক্ষেত্রে কেন ‘চার আনা’ বোনাস পাবেন এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা?  যে শিক্ষক অর্থকষ্টে ভোগেন তিনি কী পরিপূর্ণ আনন্দের সঙ্গে শিক্ষকতা করতে পারছেন? শিক্ষকতা করতে করতে নিজের জীবন তিলে তিলে ক্ষয় করছেন যে শিক্ষক তাকে ভালো থাকার অধিকার কী নেই? তাকে কী উৎসবের সময় ভালোভাবে উৎসব পালন করার অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও থাকবে না। শিক্ষকের পেছনে বিনিয়োগ সেটা তো পরোক্ষভাবে শিক্ষার্থীদের পেছনে বিনিয়োগ। এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেতন-ভাতা কম বলে মেধাবীরা এ পেশায় আসতে আগ্রহ দেখান না-এটা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষেরও অজানা থাকার কথা নয়।

এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা প্রতিবছর চেয়ে থাকেন আসন্ন ঈদে হয়তো সরকার থেকে বোনাসের ব্যাপারে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত আসবে। কত ঈদ এলো-গেল তবু সেই আশার বাণী আশায় রয়ে গেল। বর্তমান মূল্যবৃদ্ধির ক্রমবর্ধমান স্রোতে মূল বেতনের ২৫ শতাংশ উৎসব ভাতা যেনো উৎসব ভাতা পেয়েও না পাওয়ার সামিল! শিক্ষক কষ্টে থাকলেও মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারেন না। কেনোনা তার পরিচিত তিনি ‘শিক্ষক’। বিদ্যমান ২৫ ভাগ উৎসব ভাতা না পেলেও শিক্ষকের যে খুব বেশি ক্ষতি হবে বিষয়টা তা নয়, হয়তো কষ্টের বেলুনটা আরো একটু বড় হতো! সেটাও সমস্যা নয়, কেননা এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা সবকষ্ট সহ্য করতে পারেন! কষ্ট হৃদয়ে ধারণ করে শিক্ষক হাসিমুখে পাঠদান করতে পারেন। নিজের জন্য এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা কখনো ঈদের কেনাকাটা করেন না। কেনোনা বিদ্যমান বোনাস ও বেতনে সেটা করার কোনো সুযোগ নেই। তবু পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য তো ঈদের যৎসামান্য কেনাকাটা করতে হয়। দেশে এমন কোনো সেক্টর খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে গত ২০ বছরে অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের শতভাগ উৎসব বোনাসের দাবি যে তিমিরেই ছিলো সে তিমিরেই রয়ে গেছে। অথচ দেশে অন্য সব সেক্টরের চাকরিজীবীরা মূল বেতনের শতভাগ বোনাস নিয়ে উৎসব পালন করছেন।

আসলে বেতনের ২৫ ভাগ উৎসব ভাতাকে কী বলা যায়? দেশে ২০ বছর আগে মাথাপিছু আয় ছিলো প্রায় ৫৫০ মার্কিন ডলার আর বর্তমানে মাথাপিছু আয় ২৭৯৩ ডলার। তবু মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথে এগিয়ে যাওয়ার পথে অবদান রাখা একজন শিক্ষকের উৎসব ভাতা কী মূল বেতনের ‘চার আনা’ হতে পারে? সহজ কথায় এমপিওভুক্ত শিক্ষক পরিবারে ঈদের তথা উৎসবের আনন্দ নেই। যেখানে সব চাকরিজীবী পরিবারে শতভাগ বোনাস নিয়ে উৎসব পালন করা হবে সেখানে মানুষ গড়ার কারিগর ‘শিক্ষক পরিবারে’ ২৫ ভাগ উৎসব ভাতা নিয়ে ‘চার আনা’র ঈদ উৎসব পালন করা হবে। এটা কী বৈষম্য নয়? কতো দিকে কতো টাকা অপচয়ের ছড়াছড়ি। কতো শত অর্থ কেলেঙ্কারির নাটক! শুধু শিক্ষকদের বোনাস দেয়ার প্রসঙ্গ আসলেই অজুহাতের শেষ থাকে না। প্রশ্ন জাগে, এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা দিনের পর দিন ঠকছেন না তো? যে জাতি শিক্ষকদের ঠকায় সে জাতি কখনো উন্নতি লাভ করতে পারে না। 

মনে রাখা দরকার, শিক্ষকতা শুধু একটা পেশা নয়, ব্রত। এই মহান পেশাকে সম্মান ও সম্মানীর সঙ্গে পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে এগিয়ে নিতে হবে। আসন্ন ঈদের আগেই এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ‘শতভাগ উৎসব ভাতা’ পাওয়ার সময়ের যৌক্তিক দাবি পূরণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে আকুল আবেদন জানাচ্ছি।   

লেখক: সাধন সরকার, শিক্ষক, লৌহজং বালিকা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়, মুন্সীগঞ্জ

Post a Comment

0 Comments