এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে, গতবছর দীর্ঘ সময় ধরে মাধ্যমিক শিক্ষকদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ (এমপিওভুক্ত বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকগণ) জাতীয়করণের দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি সহ আমরণ অনশনের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করছেন! ঐ সময়ে সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য হয়েছি এটা দেখে যে, প্রথম দিকে একটি মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের কোনো দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় বা অন্য কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি অথবা সুশীল সমাজের প্রতিনিধি বা রাষ্ট্রের অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের পক্ষ থেকে কেউই শিক্ষকদের পাশে গিয়ে দাঁড়াননি!
কেউ যেমন শুনাননি কোনো আশার বাণী তেমনি দিতে যান নি কোনো সান্তনার বাণীও! যদিও একেবারেই শেষ মুহূর্তে তৎকালীন শিক্ষা উপমন্ত্রী (যিনি সরকারের বর্তমান মেয়াদে শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন) এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবীর বিন আনোয়ার মহোদয় এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক শামসুন্নাহার চাপা (যিনি বর্তমানে শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন) আন্দোলনরত শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে বিশেষ মেসেজ সহ বৈঠক ও আলোচনা করার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ আন্দোলনের শান্তিপূর্ণ সমাপ্তি ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন!
প্রতি বিষয়ে পাঁচ ঘণ্টার ফাইনাল পরীক্ষা!
যদিও উপুক্ত শিক্ষকগণের দাবি অযৌক্তিক বা অমূলক নয়, তথাপি এক যোগে প্রায় ২০ হাজার বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ একেবারেই সহজ বিষয়ও নয়; জাতীয়করণ আন্দোলনের শুরুর দিকে আমি এ বিষয়ে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। যেখানে আমি বলেছিলাম যে, একযোগে এই মুহূর্তে জাতীয়করণ অত্যন্ত কঠিন কেননা এটি করতে গেলে শুধু আবেগ দিয়ে কথা বললে হবে না, রাষ্ট্রের সক্ষমতার বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে!
সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও করোনা মহামারিজনিত কারণে একটি বড় ধরনের আর্থিক সংকট তৈরি হয়েছে, আর এই বিষয়ে সচেতন নাগরিক মাত্রই ওয়াকিবহাল রয়েছেন সন্দেহ নেই!
আমি মনে করি, রাষ্ট্রের সক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে পর্যায়ক্রমে (কিছু শর্ত সাপেক্ষে হলেও) মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করতে হবে- এটি সময়ের অনিবার্য দাবি। কেননা ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্নপূরণে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। আর এটি করতে গেলে মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের কোনো বিকল্প নেই। যেহেতু ভবিষ্যতে মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ সরকারের একটি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিবেচনাযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ একটি এজেন্ডা, সেহেতু এই বিষয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষকদের ব্যাপারে আন্তরিকতা ও নমনীয়তা প্রদর্শন ও জরুরী বলে মনে করি।
শিক্ষকগণ যেহেতু সকলের জন্য সমান সুযোগ লাভের অধিকারের যৌক্তিক দাবিতে এ আন্দোলন করছেন এবং নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যেহেতু প্রাইভেট কোচিংকে সরকারের পক্ষ থেকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, সেহেতু শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছাড়া নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মনে করি।
আন্দোলন চলাকালীন সময়ে লেখা নিবন্ধে আমি বলেছিলাম যে, এই মুহূর্তে জাতীয়করণ সম্ভব না হলেও তাদেরকে অন্তত কিছু সুযোগ সুবিধা বাড়িয়ে আপাতত তাদের ঘরে ফেরার মতো সম্মানজনক একটি পথ খুলে দেওয়া উচিত বলে একজন শিক্ষক হিসেবে আমি মনে করি।
আপনারা জানেন, গত ২৫ জানুয়ারি তারিখে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বাস্তবায়নের দাবিতে সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদের পক্ষ থেকে "স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বাস্তবায়ন জাতীয় কমিটি"র ব্যানারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনের প্রেক্ষিতে গত বছরের ১৮ মার্চ তারিখে (বেসরকারি শিক্ষকদের জাতীয়করণ আন্দোলন চলাকালীন সময়ে!)
জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে একই দাবিতে আয়োজিত মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই মানববন্ধনে বেসরকারি শিক্ষকদের চলমান আন্দোলনের সমাধানের আপাত উপায় হিসেবে ক্ষমতাসীন শিক্ষা বান্ধব সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে শিক্ষক নেতারা সকল পর্যায়ের শিক্ষকদের জন্য একটি মানসম্মত স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো বাস্তবায়নের দাবি জানান।
পরদিন ১৯ মার্চ আমি নিজে জাতীয় প্রেসক্লাবের সম্মুখভাগ দিয়ে শিক্ষা ভবনে যাওয়ার সময় বৃষ্টির মধ্যে খোলা আকাশের নিচে বেসিক শিক্ষকদের যে মানবেতর অবস্থায় দেখেছিলাম সে দৃশ্য সত্যিই অত্যন্ত কষ্টদায়ক ছিল! শিক্ষকদের সঙ্গে এমন অমানবিক আচরণ প্রত্যাশিত কোনো ভাবেই প্রত্যাশিত নয় বলে মনে করি।
গতবছর ঠিক এই মাহে রমজানে তাদের আন্দোলনকে আর সামনে এগোতে না দিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি পর্যায়ে তাদের সঙ্গে কথা বলে (বাস্তবতার নিরিখ) যে যৌক্তিক আশ্বাস তাদের দেওয়া হয়েছিল, একবছর পর এসে অন্তত কিছু সুযোগ সুবিধা বাড়িয়ে (ঈদ বোনাসের বিষয়টি মানবিক কারণে বিবেচনায় নেওয়া উচিত) তাদের সঙ্গে দেওয়া ওয়াদা রক্ষা করা উচিত বলে মনে করি।
সকল বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় একযোগে জাতীয়করণের বাস্তবতা বিবর্জিত আন্দোলন থেকে সম্মানজনক প্রত্যাবর্তনে সরকারের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী (তৎকালীন শিক্ষা উপমন্ত্রী) মহোদয়ের যে সাফল্য তিনি দেখিয়েছিলেন; শিক্ষকগণ তার প্রতি যে আস্থা দেখিয়েছিলেন তার প্রতিদান হিসেবে এই ঈদুল ফিতরে তাদের বাড়তি কিছু সুবিধা (শতভাগ সম্ভব না হলে কিছু কম করে হলেও!) দেওয়া উচিত বলে মনে করি।
আমি মনে করি আমাদের শিক্ষকগণ ও বাস্তবতাকে অস্বীকার করেন না, তাই বলে তাদের এমন নিয়মতান্ত্রিক এবং অহিংস যৌক্তিক আন্দোলনের কি কোনো মূল্য সরকার তথা জাতির কাছে থাকবে না? গতবছর মাহে রমজানে যে কষ্টদায়ক আন্দোলন (আমরণ অনশন ও অবস্থান কর্মসূচি) তাঁরা করেছিলেন সেই আন্দোলন থেকে তাদেরকে ঘরে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের যে উদ্যোগের ফলে সুন্দর একটি সমাধান (আলোচনা) হয়েছিল তার আলোকে কিছু সুযোগ সুবিধা বাড়িয়ে দিতে সরকার প্রধানের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
প্রকৃত অর্থে মাধ্যমিক শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে অর্থাৎ মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন এবং নতুন কারিকুলাম এর সফল বাস্তবায়নে সকল পর্যায়ের শিক্ষকগণের সামাজিক মর্যাদা ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের জন্য এই মুহূর্তে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা মনে করি। আমরা মনে করি ২০১০ এর জাতীয় শিক্ষানীতিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কাল বিলম্ব করা মোটেই সমীচীন হবে না।
মাধ্যমিক শিক্ষা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক উন্নয়নে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরকে ভেঙে একটি স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বাস্তবায়ন বর্তমান সময়ের অনিবার্য দাবি। আর স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বাস্তবায়ন করা গেলে মাধ্যমিক সেক্টর দ্রুত এগিয়ে যাবে এবং মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ সহ শিক্ষকদের জন্য একটি মানসম্মত বেতন স্কেল বাস্তবায়নও সম্ভব হবে বলে এই সেক্টরে কর্মরত শিক্ষকগণ বিশ্বাস করেন।
0 Comments