ছুটিসহ অন্যান্য কিছু সুবিধাদির যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে দু'টি কথা

অবকাশ বিভাগীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের অবকাশসহ নন-ভেকেশন ডিপার্টমেন্টের ন্যায় পুর্ণগড় বেতনে অর্জিত ছুটিসহ অন্যান্য সুবিধাদির প্রাপ্যতার যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে দু'টি কথাঃ

ছুটিসহ অন্যান্য কিছু সুবিধাদির যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে দু'টি কথা

  অবকাশ বিভাগ (Vacation Department) :

) সংজ্ঞাঃ সাধারণতঃ প্রজাতন্ত্রের যে সকল প্রতিষ্ঠান বা দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্টগণ দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বা দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্টদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি দিন অবকাশ (Vacation) ভোগ করেন বা পান সেগুলোকে অবকাশ বিভাগ বলে। অবকাশ বিভাগ অর্থ ঐরূপ বিভাগ বা বিভাগের অংশ বিশেষ, যেখানে নিয়মিত অবকাশ অনুমোদিত এবং কর্মরত সরকারী কর্মচারীগণ অবকাশকালে কর্মে অনুপস্থিত থাকার অনুমতিপ্রাপ্ত। [SR263/Rule 5(51), B.S.R]

ক্লাস চলাকালে অসুস্থ ৩৫ শিক্ষার্থী, স্কুল ছুটি ঘোষণা

তাই বিধিগতভাবে যে সমস্ত দপ্তর অথবা দপ্তরের অংশ বিশেষকে নিয়মিত অবকাশ যাপনের অনুমতি প্রদান করা হয়, সেই সমস্ত বিভাগকে অবকাশ বিভাগ বলা হয়। এই অবকাশ সময়ে উক্ত দপ্তরে কর্মরত সরকারি কর্মচারীগণকে দায়িত্ব পালনে অনুপস্থিত থাকতে অনুমতি প্রদান করা হয়।

) অবকাশ বিভাগের অন্তর্গত প্রতিষ্ঠান কর্মকর্তাগণঃ

নিম্ন লিখিত সরকারি কর্মচারীগণ অবকাশ বিভাগের আওতায় পড়েনঃ- () বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাগণ; () পরিদর্শক কর্মকর্তা প্রাতিষ্ঠানিক কর্মচারী ব্যতীত শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাগণ; () সকল পলিটেকনিক বিদ্যালয় এবং কারিগরী শিল্প বিদ্যালয়ের কর্মকর্তাগণ; () ঢাকা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের ফিজিওলজি এনাটমির প্রফেসরবৃন্দ, রসায়ন ফিজিওলজি এনাটমির সহকারী প্রফেসরবৃন্দ; () চিকিৎসা বিদ্যালয়সমূহের তত্ত্বাবধায়কগণ কর্তৃক বিদ্যালয়সমূহ নির্ধারিত হাসপাতালের দায়িত্বে নিয়োজিত উপ-তত্ত্বাবধায়কগণ ব্যতীত সকল চিকিৎসা বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং প্রদর্শক, ঢাকা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের এপিডোস্কোপ অপারেটর; () ঢাকা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের এনাটমির ফিজিওলজি বিভাগের প্রদর্শকগণ, রসায়ন বিভাগের চিকিৎসক প্রদর্শকগণ; () রাজশাহী মহাবিদ্যালয়ের সরকারি ছাত্রাবাসের চিকিৎসা কর্মকর্তা; () ঢাকা খামারে নিয়োজিত এগ্রোনামির প্রফেসর (যাহার ছুটি যতদিন তিনি ঢাকা খামারের দায়িত্বে থাকিবেন ততদিন ধরিয়া সাধারণ বিধি মোতাবেক পরিচালিত হইবে) ব্যতীত কৃষি বিদ্যালয়ের কর্মকর্তা কর্মচারীগণ; () সরকারি স্বত্ব নিয়োগী (Official Assignee) বাংলাদেশ; (১০) সরকারি গ্রাহক (Official Reciver) হাইকোর্ট, ঢাকা।

২। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাজের ধরণঃ

একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একাডেমিক/পাঠদান দাপ্তরিক/প্রশাসনিক দুধরণের কার্যক্রমের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ মানে এর একাডেমিক/পাঠদান দাপ্তরিক/ প্রশাসনিক উভয় ধরণের কার্যক্রম বন্ধকে বুঝায়। কিন্তু সাপ্তাহিক সরকারী ছুটি ব্যতিত শীতকালীন, গ্রীষ্মকালীন, রোজা, জাতীয়/ধর্মীয় দিবসের ছুটি ইত্যাদিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক/পাঠদান আংশিক বা পুরাপুরি বন্ধ থাকলেও কখনই এর প্রশাসনিক/দাপ্তরিক কার্যক্রম তথা অফিস বন্ধ থাকে না; শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাপ্তরিক/প্রশাসনিক করতে হয়।

৩। শিক্ষকের কর্মের কাজের ধরণঃ

শিক্ষকতা পেশা এমন একটি কর্ম যার একাডেমিক দায়িত্ব তিনটি অংশে বিভক্ত যথাঃ ) পাঠ পূর্ব প্রস্তুতি, ) শ্রেণি কার্যক্রম/পাঠদান ) মূল্যায়ন কার্যক্রম। শিক্ষার্থীদের পাঠদান/শ্রেণি কার্যক্রম চলে প্রাত্যহিক কর্ম ঘন্টার (Working hours) মধ্যে শ্রেণিকক্ষে, আর তাদের পাঠদানের জন্য শিক্ষক/শিক্ষিকার পাঠ পূর্ব প্রস্তুতি মূল্যায়ন কার্যক্রম চলে প্রতিনিয়ত প্রাত্যহিক কর্ম ঘন্টার বাইরে, প্রায়শঃ শিক্ষক মিলনায়তন, গ্রন্থগার শিক্ষক/শিক্ষিকার নিজ গৃহে। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন কার্যক্রমের মধ্যে পড়ে টেষ্ট অভীক্ষা বা প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, পরীক্ষা গ্রহণ, উত্তরপত্র মূল্যায়ন, বাড়ির কাজ মূল্যায়ন, ব্যবহারিক কাজ মূল্যায়ন ফলাফল প্রস্তুত ইত্যাদি। ছাড়া পাঠদান কার্যক্রম কৌশল উন্নয়ন এবং কার্যকর পাঠদানের জন্য একজন শিক্ষককে প্রতিনিয়ত পাঠ পূর্ব প্রস্তুতির জন্য তথা পাঠ পরিকল্পনা তৈরি, অধ্যায়ন বা গ্রন্থগার কর্মের জন্য প্রতিদিন প্রাত্যহিক কর্ম ঘন্টার বাইরে একটি উল্লেখযোগ্য সময় (প্রায় ঘন্টা) ব্যয় করতে হয়, যা অন্য কর্ম/চাকরিতে দেওয়ার প্রয়োজন হয় না বা দিতে হয় না। শিক্ষকের সমস্ত কাজ অন্যান্যদের ন্যায় প্রাত্যহিক কর্ম ঘন্টার মধ্যেও করা যায় না, প্রাত্যহিক কর্ম ঘন্টার বাইরে গ্রন্থগার, গবেষণাগার বাসায় করতে হয়।

৪। তুলনামূলক আলোচনাঃ

) দেশের অন্যান্য অবকাশ বিভাগের মধ্যে বিচার বিভাগ একটি। সে হিসেবে বিচার বিভাগ আর শিক্ষা বিভাগ একই অনুপাতে ছুটি/অবকাশ ভোগ করার কথা। কিন্তু বিচার বিভাগের ছুটির তালিকায় দেখা যায়, ২০১৮ সালে ছুটির তালিকা অনুযায়ী তারা ১৮১ দিন ছুটি ভোগ করেছেন, ২০১৯ সালে ভোগ করছেন ১৮৪ দিন। সে তুলনায় শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ছুটি ভোগ করেন ৭৯ দিন+৫২ (শুক্রবার) দিন= ১৩১ দিন। আবার অবকাশ বিভাগ নয় এমন বিভাগগুলো ছুটি ভোগ করে ৫২+৫২ (শুক্র+শনি)+২২ নির্বাহী ছুটি=১২৬ দিন। ১৩১ দিনের মধ্যে জাতীয় দিবস ৮টিতে শিক্ষকগণ ছুটি উপভোগের সুযোগই পান না, কারণ দিবসগুলোতে তাদেরকে বিদ্যালয়ে এসে শিক্ষার্থীদের নিয়ে তা উদযাপন করতে হয়। তাই আমাদের দেশের শিক্ষক নন-ভেকেশন বিভাগের চেয়ে ছুটি বেশি ভোগ করে ১৩১-১২৬= দিন মাত্র।

) প্রসংগে কয়েকটি দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক/শিক্ষিকাদের বেতন-ভাতা মর্যাদার কথা নাই বল্লাম, তাদের শুধু বাৎসরিক ছুটির তালিকা নিম্নে উল্লেখ করলামঃ ইরান-১২৫দিন, সৌদি আরব-১১৫ দিন, ভারত-১১৪ দিন, পাকিস্তান-১১০৫ দিন, যুক্তরাজ্য-১০০ দিন, জার্মানি-৯০ দিন, জাপান-৮০ দিন। আর বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি মাত্র ৭৫ দিন।

) ছুটি বিধি ১৯৫৯' অনুযায়ী শিক্ষা বিভাগের শিক্ষক-কর্মকর্তারা অন্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ন্যায় বেতনে প্রতি ১২ দিনে দিন অর্ধগড় বেতনে অর্জিত ছুটি পান। কিন্তু অবকাশ বিভাগ বাদে অন্য বিভাগের কর্মচারী-কর্মকর্তারা গড় বেতনে প্রতি ১১ দিনে একদিন অর্জিত ছুটি পেলেও অবকাশ বিভাগ হিসাবে মাত্র দিন বেশি ছুটি ভোগ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক/শিক্ষিকাগণর পুর্ণগড় বেতনে কোন অর্জিত ছুটি পান না। ফলে অবসরকালে এককালীন অনুদান, আনুতোষিক অবসর ভাতা কম পেয়ে ব্যাপকহারে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন।

৫। শিক্ষার্থীদের অবকাশের প্রয়োজনীয়তাঃ

অপরদিকে বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, শিশু বিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, শিক্ষা মনোবিজ্ঞানীগণ বাড়ন্ত শিশু, কিশোর, তরুণদের জেনেটিক বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় এবং মানসিক শারিরীক বিকাশ যাতে যথাযথ পরিপূর্ণ হয় তাই বিদ্যালয়ে নিয়মিত উপস্থিতির পাশাপাশি তাদের জন্য পর্যাপ্ত ছুটির প্রয়োজন হয়। জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটির প্রয়োজন গুরুত্ব অনেক বেশি। আবার বিচারকদেরও রায় লেখাসহ কিছু কর্ম প্রাত্যহিক কর্ম ঘন্টার বাইরে তাঁর খাসকামরা বাসায় প্রতিনিয়ত করতে হয়। কারণে এখানে অবকাশ/ছুটি বেশি হলেও পেশার দায়িত্বের প্রকৃতিগত কারণে বাস্তবে বর্ধিত ছুটি/অবকাশ শিক্ষক/শিক্ষিকা, বিচারকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ উপভোগ করতে পারেন না।

৬। উপসংহারঃ

) তাই শিক্ষক/শিক্ষিকা বিচারকদের কর্মোদ্যম সজীবতা ফিরিয়ে আনতে এবং মানসিক চাপ লাঘব, কর্ম ক্লান্তি, একই কাজ বাবা করার কারণে সৃষ্ট একগুয়েমি দুর সুস্থ্যতার জন্য অবকাশ বা ছুটির বিশেষ প্রয়োজন। জন্য বিভিন্ন দেশের সরকার তাদের জন্য পর্যাপ্ত ছুটি ব্যবস্থা করেছেন। ছুটিকালীন সময়ের অধিকাংশ সময় এদেরকে বিদ্যালয়/দপ্তরের অনেক কাজ যেমন পরিকল্পনা তৈরি, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, উত্তরপত্র/ এসাইমেন্ট মূল্যায়ন, বাড়ির কাজ মূল্যায়ন ইত্যাদি গ্রন্থগার, গবেষণাগার বাসায় করতে হয়। সকল কাজের জন্য শিক্ষকগণকে অতিরিক্ত কোন সুবিধাদি দেয়া হয় না। উপরে বর্ণিত কারণে শিক্ষকতা পেশার পেশাজীবি শিক্ষক/শিক্ষিকাদের অবকাশসহ (Vacation) নন-ভ্যাকেশন ডিপার্টমেন্টের ন্যায় পুর্ণগড় বেতনে অর্জিত ছুটিসহ শ্রান্তি বিনোদন ছুটি অন্যান্য ছুটি সুবিধাদি প্রাপ্য এবং পাওয়ার ন্যায় সংগত অধিকার রাখে এবং এদেরকে অতিসত্বর তা দেয়া উচিত।

) জাতীয় শিক্ষানীতি, ২০১০ এর অধ্যায় ২৫ শিক্ষকের মর্যাদা, অধিকার দায়িত্ব বিষয়ের কৌশল ১০ বলা হয়েছে যে, "সরকারি, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের অন্যান্যদের মতো অর্জিত ছুটির ব্যবস্থা থাকবে।" জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি শাখা- তার ২০/০৭/২০১১ তারিখের স্মারক নং ০৫.০০.০০০০.১৭৩.০৮.০১২.০৭-২৪৪ মাধ্যমে জানিয়ে দেন যে, সার্বিক দিক বিবেচনায় শিক্ষা সেক্টরকে নন-ভেকেশন বিভাগ ঘোষণা যথাযথ হবে না, তবে বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা), বিসিএস (কারিগরী শিক্ষা) এবং শিক্ষা সেক্টরের অন্যান্য শিক্ষকদের শ্রান্তি বিনোদন ছুটি, গড় বেতনে অর্জিতছুটিসহ অন্যান্য ছুটির প্রাপ্যতার বিষয়টি বিবেচনাযোগ্য বিধায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অর্থ বিভাগের সম্মতি সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু মন্ত্রণালয় ২টি আজ অবধি বিষয়ে কোন উদ্যোগ নিয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। তাই জরুরী ভিত্তিতে উদ্যোগ নেওয়া উচিত, তাই নয় কি? ধন্যবাদ (সমাপ্ত)

মোঃ মঈন উদ্দীন

সিনিয়র শিক্ষক (ব্যবসায় শিক্ষা)

মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়, ঢাকা।


Post a Comment

0 Comments