শতাধিক ফ্ল্যাট অসংখ্য প্লট একর একর জমির মালিক

হয়তো ক্যালকুলেটরেও ধরবে না তাঁর সম্পদের টাকার অঙ্ক! শতাধিক ফ্ল্যাট, ডজন ডজন প্লট, একর একর জমি, পুকুর, খেলার মাঠ, নদীর চর থেকে শুরু করে বাস টার্মিনাল– কী নেই পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি হামিদুল আলম মিলনের! এই পুলিশ কর্মকর্তার সম্পদশালী হওয়ার চিত্রনাট্য রীতিমতো অবিশ্বাস্য। তাঁর টাকার ঝলকানিতে আচকা ধনকুবের স্ত্রী, ভাইবোন থেকে শুরু করে শ্বশুরবাড়ির লোকজনও। এই সরকারি চাকুরের টাকার হিসাব কষতে খোদ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তাদেরও ছুটছে ঘাম। 

শতাধিক ফ্ল্যাট অসংখ্য প্লট একর একর জমির মালিক
 

গেল জাতীয় নির্বাচনে অর্ধাঙ্গিনী শাহজাদি আলম লিপিকে বগুড়া-১ আসনে স্বতন্ত্র হিসেবে দাঁড় করিয়ে তাঁর পক্ষে সরকারি গাড়ি নিয়ে প্রচারে নেমে নতুন করে আলোচনার খাতা খোলেন পুলিশের এই বড় কর্তা। এ অভিযোগে সে সময় বরিশাল মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মিলনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।


শিক্ষাক্রম ও শিক্ষাব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ


নদীভাঙন বগুড়ার সারিয়াকান্দির মানুষের নিয়তি হলেও ব্যতিক্রম কেবল হামিদুল আলম মিলন। তিনি নিজেই যেন নিজের ভাগ্য লিখেছেন। সারিয়াকান্দির তাজুরপাড়া গ্রামের কৃষক ইবনে আজিজ মন্টু তাঁর বাবা। তিন ভাই ও পাঁচ বোনের পরিবারে পড়ালেখার খরচ জোগাতে ছাত্রজীবনে টিউশনি থেকে শুরু করে নানা কাজ করতেন। তাঁর এক ভাই বেঁচে নেই। বড় ভাই জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা শাখার মাঠ কর্মকর্তা। বোনদের মধ্যে একজন স্কুলশিক্ষিকা, বাকিরা গৃহিণী।

 

২০তম বিসিএসের মাধ্যমে পুলিশে যোগ দেওয়ার পর বদলে যায় মিলনের জীবনগল্প। দুই যুগের চাকরিজীবনে সম্পদের পর সম্পদ গড়েছেন; কখনও নামে, কখনও বেনামে। শুধু বগুড়া শহরের আশপাশেই রয়েছে তাঁর কয়েকশ কোটি টাকার সম্পদ। আলিশান বাড়ি আছে প্রত্যন্ত গ্রামে। আছে বেশ কয়েকটি বিলাসবহুল গাড়ি। কথায় কথায় নিজ এলাকায় লাখ লাখ টাকা খরচা করার অভ্যাস মিলনের। স্ত্রীকেও বানাতে চেয়েছিলেন সংসদ সদস্য। এ জন্য দু’হাতে খরচাও করেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। তবে সেই মনোবাঞ্ছা পূরণ হয়নি।

 

হামিদুল আলম মিলন শুধু নিজ পরিবারেরই আঁধার ঘোচাননি; টাকার রোশনাই ছড়িয়ে হাসি ফুটিয়েছেন শ্বশুরবাড়ির লোকজনের। তেমন কোনো উপার্জন না থাকলেও শ্বশুর-শাশুড়ি, শালা-সম্বন্ধীর নামে এখন আছে বিপুল পরিমাণ জমি। এসব জমি বিভিন্ন সময় মিলন তাদের নামে কিনেছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। মিলনের শ্বশুরবাড়ি বগুড়ার গাবতলীর চকসদু গ্রামে। তাঁর শ্বশুর শহিদুল্লাহ পল্লিচিকিৎসক। স্ত্রীর ভাইদের মধ্যে কেউ কৃষিজীবী, কেউ ভূমি সার্ভেয়ার, কেউ পল্লিচিকিৎসক। লিপির বড় বোন বিলকিস গৃহিণী। বিলকিসের স্বামী আব্দুর রশিদ কলেজের শিক্ষকতা শেষে এখন অবসরে।

 

পুলিশে যোগ দেওয়ার পর ভালো জেলায় চাকরি করার সময় কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা পকেটে তোলেন তিনি। মিলনের স্ত্রী শাহজাদি আলম লিপি নিজেকে ব্যবসায়ী পরিচয় দিলেও তাঁকে কখনও ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে দেখা যায়নি। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, কালো টাকা সাদা করতে তারা ব্যবসাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন। স্ত্রীর নামে এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যবসা আর মেধা এন্টারপ্রাইজ নামে ডেভেলপার ব্যবসা দেখাশোনা করেন লিপির বড় ভাই নুর আলম। 

 

যেন সম্পদের সাগর

নিজ জেলা বগুড়ায় প্লট ও ফ্ল্যাটে সেঞ্চুরি করেছেন মিলন-লিপি দম্পতি। শহরের অভিজাত এলাকা মালতিনগরে একটি ১০ তলা ভবনে তারা ৩৪টি ফ্ল্যাটের মালিক। এ ছাড়া সিভিল সার্জন অফিসের পাশে ৪ শতাংশ, ঠনঠনিয়া তেঁতুলতলায় ১০ দশমিক ৩৩ শতাংশ জায়গায় একটি দোতলা বাড়ি, জেলা পরিষদের পেছনে ভবনসহ ৭ শতাংশ জায়গা, খান্দার আবহাওয়া অফিসের পূর্বপাশে ৩৩ শতক জায়গা কিনেছেন। এ ছাড়া বগুড়া সদরে মালতিনগর ও সূত্রাপুর মৌজায় একটি ১০ তলা ভবনের নির্মাণকাজ শেষের দিকে। সেখানে প্রতি ফ্লোরে ৮টি; মোট ৭২টি ফ্ল্যাট রয়েছে স্ত্রীর নামে।

 

ঢাকার বেইলি রোডের রূপায়ণ সিটিতে দুটি ও উত্তরায় একটি অভিজাত ফ্ল্যাট রয়েছে মিলনের স্ত্রী লিপির নামে। এ ছাড়া বাড্ডা ও মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধে আরও জমি এবং বিভিন্ন ব্যাংকে কোটি কোটি টাকার এফডিআর থাকার তথ্য জানা গেলেও প্রয়োজনীয় নথি সংগ্রহ করতে পারেনি সমকাল। 

 

এ ছাড়া তাদের সম্পদের তালিকায় রয়েছে নদীর চর থেকে শুরু করে বাস টার্মিনাল, পুকুর, খেলার মাঠ। এত সম্পত্তির হিসাব কষতে গিয়ে দুদক কর্মকর্তারা পেরে উঠছেন না। নিরুপায় হয়ে সহযোগিতা চেয়ে সংস্থাটি চিঠি পাঠিয়েছে বিভিন্ন উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে। 

 

কেনেন বাস টার্মিনালও 

বগুড়া শহরের চেলোপাড়ার ব্যস্ততম সড়কের পাশে ফাঁকা জায়গাটি ছিল আঞ্চলিক বাস টার্মিনাল। হঠাৎ সেখান থেকে টার্মিনালটি সরিয়ে নেওয়া হয়। ঘিরে রাখা জায়গাটি একসময় কেনাবেচা হয়। তবে কে কিনছে, সে তথ্য কারও জানা ছিল না। 

সমকাল জানতে পেরেছে, চেলোপাড়া মৌজার জমিটি ২০২৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর গোপনে বিক্রি করা হয়। দলিলে ১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা বিক্রয়মূল্য দেখানো হলেও আদতে লেনদেন হয়েছে অন্তত ২০ কোটি টাকা। আর ৩৭ দশমিক ১৮ শতাংশের এই জায়গাটি বাজারদরের চেয়ে কম দামে কিনেছেন আজিজা সুলতানা নামে এক নারী। আজিজা মিলনের ছোট বোন। তিনি স্বামী মোস্তাক আহম্মেদের সঙ্গে ইতালি থাকেন। 

 

নথিপত্র যাচাই করে আজিজার নাম পাওয়া যায় সারিয়াকান্দির তাজুরপাড়া মৌজায় একটি ব্যক্তিমালিকানা জমির বণ্টননামা দলিলে। ২০২২ সালের ২৮ জুলাই বণ্টননামা দলিলটি করা হয়। সেখানে হামিদুল আলম মিলন ২৭ একর ১৩ শতাংশ জমি ভাইবোনের মাঝে বণ্টন করে দেন। অভিযোগ আছে, এই দলিলের মাধ্যমে নিজে জমি কিনে ভাইবোনের বাটোয়ারা করে দিয়ে দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছেন তিনি।

 

এ ঘটনার প্রায় তিন বছর আগে একই মৌজার ১ একর ৮৪ শতাংশ জমি মিলন এবং তাঁর বড় ভাই এনএসআইর মাঠ কর্মকর্তাকে হেবা দলিল করে দেন আরেক বোন আলেয়া সালমা। এলাকাবাসী জানান, সুপরিকল্পিতভাবে এ পরিবারের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে জমি কেনাবেচা করে চলেছেন। অনেক জমি মিলন তাঁর আত্মীয়স্বজনের নামে কিনে পরে দানপত্র দলিলের মাধ্যমে বৈধতা দিয়েছেন।

 

মিলন ও লিপির যত সম্পত্তি 

বগুড়া সদরের আকাশতারা মৌজায় বিভিন্ন দাগে ২ একর ২১ দশমিক ৭৫ শতাংশ, ঠনঠনিয়া মৌজায় ১০ দশমিক ৩৩ শতাংশ ও মালতিনগর মৌজায় ১১ শতাংশ জমি কিনেছেন মিলন। এ ছাড়া সারিয়াকান্দির তাজুরপাড়া, বরুরবাড়ি, রামকৃষ্ণপুর, পারতিতপরল, খোদ্দবলাইল ও অন্তারপাড়া মৌজায় ভিন্ন ভিন্ন দাগে ৩৪ একর ৯২ শতাংশ জমি রয়েছে এ দম্পতির। 

 

স্বজনের নামেও আছে 

মিলন-লিপি দম্পতির পরিবারের সদস্য (শ্বশুরবাড়ি) প্রত্যেকের নামে বিপুল সম্পত্তি থাকার প্রমাণ মিলেছে। লিপির বাবার বাড়ি গাবতলীর চকসদু গ্রামে তথ্যানুন্ধান করে দেখা গেছে, তাঁর বাবা শহিদুল্লাহ, মা সাফিয়া বিবি, ভাই ছামসুল হুদা, শওকত হুদা, নুরে আলম সিদ্দিকের নামে রয়েছে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি। এর মধ্যে শুধু চকসদু মৌজায় ৯ একর ৭৫ শতাংশ জমি রয়েছে। আরএস খতিয়ান নথিতে ধানি, ভিটা, বাড়ি, বাঁশঝাড়, বাগান, ডোবা, খলিয়ান (উঠান) হিসেবে জমিগুলো শ্রেণিভুক্ত করা হয়। এ ছাড়া মিলনের ছোট বোন আজিজা সুলতানার নামে বগুড়া সদরের চেলোপাড়া মৌজায় ৩৭ দশমিক ১৮ শতক, সারিয়াকান্দি মৌজায় ৪৪ শতক জায়গা রয়েছে।

 

দুদকের তৎপরতা 

পুলিশ কর্মকর্তা হামিদুল আলম মিলন, তাঁর স্ত্রী শাহজাদি আলম লিপি, সন্তান সাবিব শিহাব, হামিদা আফসারা মেধা ও সাদিকুল্লাহ সাবিরের সম্পত্তি অনুসন্ধান করছে দুদক। বগুড়া জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম গত বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি দুদক প্রধান কার্যালয়ের একটি চিঠির অংশ হিসেবে জেলা সাব-রেজিস্ট্রি ও সব উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে পাঠান। এতে উল্লেখ করা হয়, মিলনের বিরুদ্ধে অবৈধ উপায়ে বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিকানা অর্জন-সংক্রান্ত একটি অভিযোগ অনুসন্ধানের স্বার্থে দলিল রেজিস্ট্রি-সংক্রান্ত তথ্য প্রয়োজন। এ ব্যাপারে বগুড়া দুদক কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হলে তারা তদন্তের অগ্রগতি-সংক্রান্ত কোনো তথ্য জানাতে রাজি হয়নি।

 

সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান (সুপ্র) বগুড়া জেলা সম্পাদক কেজিএম ফারুক বলেন, একজন সরকারি কর্মচারীর নিজের ও আত্মীয়স্বজনের নামে বিপুল পরিমাণ স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি অর্জনে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। একজন পুলিশ কর্মকর্তা নিজ জেলা ছাড়া বিভাগীয় প্রধানের অনুমতি ব্যতীত জায়গা-জমি কিনতে পারেন না। সেখানে এ ধরনের অবৈধ সম্পদ অর্জন প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে বলে আমরা মনে করি।

 

যা বললেন পুলিশ কর্তা

পুলিশ প্রবিধানের ১১২ ধারার (গ) এ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো পুলিশ কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (আইজিপি) কিংবা পুলিশ সদরদপ্তরের অনুমতি ছাড়া তাঁর নিজ জেলা ছাড়া কোথাও নিজের বা স্বজনের নামে জমি কিনে বাড়ি করতে পারবেন না। অনুমতি নিয়ে সম্পত্তি কিনেছেন কিনা– জানতে চাইলে হামিদুল আলম মিলন বলেন, ‘এতটা ভেবে কিছু করিনি। অনেক আগে থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য করতাম। এখন আমার স্ত্রী বিভিন্ন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। পারিবারিকভাবে আমরা অবস্থাশালী। পৈতৃকসূত্রে আমি এবং আমার স্ত্রী অনেক জায়গা পেয়েছি। আমার ভাইবোনও ভালো রোজগার করে। এ কারণে হয়তো আমরা অনেক সম্পদশালী মনে হয়।


এত বাড়ি, মার্কেট ও জমি কেনার টাকার উৎস প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মিলন বলেন, বেশির ভাগ টাকাই ব্যবসা থেকে এসেছে। চাকরি করার সময় ভালো ভালো জেলায় ছিলাম। ইচ্ছা করলে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামাতে পারতাম। তবে সৎভাবে চাকরি করেছি। সেসব জেলায় খোঁজ নিলে জানতে পারবেন। আমার চাইতেও বেশি সম্পদের মালিক আছে অনেকে। সেগুলোর ব্যাপারে আপনাদের খোঁজখবর করা উচিত।

লিমন বাসার, উত্তরাঞ্চল

দৈনিক সমকাল

Post a Comment

0 Comments